৯ম-১০ম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনাঃ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার প্রতিকার
ভূমিকা : প্রকৃতপক্ষে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশি আক্রান্ত হয়। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন এ দেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। দেশটি নদীবাহিত পলিমাটিতে তৈরি একটি বদ্বীপ। বিশাল গঙ্গা-যমুনা-মেঘনার প্রবাহ মিলিয়ে সাত শত নদ-নদী বয়ে গেছে এ দেশের ওপর দিয়ে। তার ওপর এ দেশের দক্ষিণাংশজুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর- যার আকার অনেকটা ওল্টানো ফানেলের মতো। ফলে সাগরে ঝড় উঠলেই প্রবল দক্ষিণা হাওয়ার তোড়ে সমুদ্রের লোনা পানি উঁচু হয়ে গড়িয়ে পড়ে নিচু উপকূলে। এতে সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, টর্নেডো, সাইক্লোন- তার সঙ্গে নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস ও জমিতে লবণাক্ততার আক্রমণ-এসব প্রায় প্রতিবছর লেগেই আছে। এমনি নানা দুর্যোগ এ দেশের মানুষের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নকে তছনছ করে দেয়।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। আমাদের দেশ নদীমাতৃক ও সমতল। সমুদ্রপৃষ্ঠে থেকে সামান্য উঁচু এ দেশে প্রায় প্রতিবছর কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয়। নিম্নে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিচয় তুলে ধরা হলো,
বন্যা : আমাদের দেশ একটি সমতল ভূমি, এর বুক চিরে প্রবাহিত হচ্ছে অসংখ্য নদ-নদী। হিমালয় ও অন্যান্য পর্বতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বরফগলা পানি নেমে আসার কারণে আমাদের নদ-নদীগুলো ধারণক্ষমতা হারায়। ফলে নদীর তীর উপচে মূল ভূখন্ড প্লাবিত হয়। ১৯৭৪ সালের বন্যার কারণে ফসলহানিতে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। ১৯৮৮ ও ২০০৭ সালের বন্যা সবচেয়ে ভয়াবহতম। এতে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫০/৫৪টি জেলাই প্লাবিত হয়।
জলোচ্ছ্বাস : বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাস একটি ভয়াবহ দুর্যোগ। ১৯৬০, ১৯৭০, ১৯৮৫, ১৯৯১ ও ১৯৯৭ সালের জলোচ্ছ্বাস ছিল বিভীষিকাময়। ১৯৭০ সালের সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় বিশাল এলাকাকে পরিণত করেছিল মৃত্যুপুরীতে। এ জলোচ্ছ্বাসে ৫ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৮৫ সালের ঘূর্ণিঝড়ে উড়িরচর নামক জনপদ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সবচেয়ে মারাত্মক জলোচ্ছ্বাসটি বাংলাদেশে আঘাত হানে। এতে দেশের ১৬টি জেলার ৪৭টি উপজেলা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জলোচ্ছ্বাসে পানি ২০ ফুট উঁচু হয়ে উপকূলে আঘাত হানে। এতে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় চার লক্ষাধিক মানুষ ও প্রাণী প্রাণ হারায়।
মৌসুমি ঝড় : গ্রীষ্মকাল বাংলাদেশে মৌসুমি ঝড়ের সময়। গ্রীষ্মকালে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে কালবৈশাখী ঝড় হয়। ১৯৮৯ সালে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় এবং ১৯৯১ সালে খুলনায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের কবলে সমগ্র এলাকা মুহূর্তেই বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয়। ২০০২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় এবং ২০০৪ সালে নেত্রকোনা জেলায় ভয়ংকর ঝড়ে বিশাল এলাকা জুড়ে ধ্বংসলীলা চলে।
নদীভাঙন : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর যেমন দান রয়েছে এ দেশে, তেমনি রয়েছে ধ্বংসলীলাও। প্রতিবছর নদীভাঙনে লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে পথের ভিখারিতে পরিণত হচ্ছে। জামালপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, চাঁদপুর নদীভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বগ্রাসী পদ্মার গ্রাসে অসংখ্য জনপদ বিলীন হয়ে গেছে অবলীলায়।
ভূমিকম্প : বাংলাদেশ সুনিশ্চিতভাবে ভূমিকম্প বলয়ে অবস্থিত। যেকোনো মুহূর্তে আমাদের দেশে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হতে পারে। বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় তীব্র ভূমিকম্প হতে পারে। বাংলাদেশে যদিও এ পর্যন্ত বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি, তবে বড় কোনো ভূমিকম্প হলে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে তা কল্পনাতীত।
দুর্যোগ প্রতিরোধের উপায় : প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি অভিশাপ। এ অভিশাপ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে বিশ্বজুড়ে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। এসব প্রস্তুতির মধ্যে পড়ে আগাম সতর্কতা, দুর্যোগকালে ক্ষয়ক্ষতির প্রশমন, দুর্যোগের পর পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন, দুর্যোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতে যাতে দুর্যোগ না ঘটে সেজন্য অবকাঠামোগত ও সামাজিক উন্নয়নের ব্যবস্থা করা। এসবের প্রস্তুতিকল্পে বাংলাদেশও বেশ সোচ্চার। আমাদের দেশে চিরাচরিতভাবে দুর্যোগ মোকাবেলা বলতে বোঝায় দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার পর সাহায্য দানের মাধ্যমে তার ক্ষয়ক্ষতি নিরসনের চেষ্টা করা। কিন্তু আজ আর এই ধারণা নিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলা হচ্ছে না। এর জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে অভিনব পদ্ধতিতে। যেমন
১. দুর্যোগ ঘটার পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং সেজন্যে বিশেষ ধরনের কর্মীবাহিনী সৃষ্টি এবং জনগণকে প্রশিক্ষিত করে তোলা।
২. জাতীয় ভিত্তিতে দুর্যোগ মোকাবেলা করার নীতিমালা পরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন।
৩. জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা।
৪. পরীক্ষিত পদ্ধতির ভিত্তিতে যথাসময়ে সতর্কতা সৃষ্টির আয়োজন।
৫. দ্রুুত ক্ষয়ক্ষতি ও চাহিদা নিরূপণের ব্যবস্থা করা।
৬. তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা উন্নত করা।
৭. সামরিক বাহিনীকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাজে সমন্বয় সাধন করা।
৮. থানা, জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি নিয়ে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা।
৯. দুর্যোগ মোকাবেলায় নিয়োজিত কর্মীবাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
১০. সর্বোপরি দুর্যোগের সম্ভাব্যতা ও সেগুলোর মোকাবেলা করার পদ্ধতি সম্বন্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ : বাংলাদেশেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় ভিত্তিতে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। দুর্যোগ সংক্রান্ত কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন, গণসচেতনতা বৃদ্ধি, তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা, গবেষণাকর্ম পরিচালনা, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রশমন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা দান প্রভৃতির উদ্দেশে ১৯৯৩ সালে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো। দুর্যোগের কারণে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসসহ দুর্যোগ-উত্তরকালে জাতীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য।
উপসংহার : এককালে মানুষের ধারণা ছিল প্রকৃতির ওপর যেকোনো উপায়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই সবচেয়ে জরুরি। আজ সে ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। কেননা দেখা যাচ্ছে, এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বন ধ্বংস করে, নদীর প্রবাহ বন্ধ করে, পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে মানুষ নিজের জন্যে সমূহ বিপদ ডেকে এনেছে। তাই আজ প্রকৃতির ওপর আধিপত্য নয়, মানুষ গড়ে তুলতে চাইছে প্রকৃতির সঙ্গে মৈত্রীর সম্বন্ধ। আর চেষ্টা করছে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রেখে প্রকৃতির সহায়তায় তার নিজের জীবনধারাকে আগামী দিনের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।