৯ম-১০ম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনাঃ একটি শীতের সকাল
ভূমিকা : বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। পালাক্রমে ছয়টি ঋতু এসে বাংলাদেশকে নব নব রূপে সাজায়। সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে তারা আসে আর যায়। বসন্ত ঋতুর আগে এর আগমন ঘটে। প্রকৃতিকে কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে নিতে আবির্ভাব ঘটে শীতকালের। আর শীতের সকাল এক বিচিত্র অনুভূতির সঞ্চার করে মানবমনে। এ সময় প্রকৃতি রিক্ততার সন্ন্যাসী রূপ ধারণ করে যেন। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে মানুষের মনে অলসতা ভর করে। চাদর মুড়ি দিয়ে শীতকে দূরে ঠেলার প্রগাঢ় চেষ্টায় লিপ্ত মানুষ বারবার ব্যর্থ হয়। ধরণীর বুকে শীতের আগমন আনে বৈরাগ্যের সুর। এর সাথে সাথে শীতের সকালও একই রূপ পরিগ্রহ করে। তাই বুঝে কবি বলেনÑ
“হিম হিম শীত শীত
শীত বুড়ি এলো রে,
কনকনে ঠান্ডায়
দম বুঝি গেলো রে।”
শীতকালের বৈশিষ্ট্য : ষড়ঋতুর মধ্যে পঞ্চম ঋতু হলো শীতকাল। পৌষ ও মাঘ এ দুই মাস শীতকালের ব্যাপ্তি থাকে। ইংরেজি বর্ষপঞ্জি অনুসারে মোটামুটি নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীত অনুভূত হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালের বিপরীত অবস্থানে থাকে শীতকাল। বর্তমান সময়ে শীতকালে আবার বৃষ্টি হতেও দেখা যায়। প্রবল শৈত্যপ্রবাহে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সাধারণ মানুষের প্রাণহানিও ঘটে।
শীতের সকালের স্বরূপ : কুয়াশার চাদরে মোড়া শীতের সকাল হাড় শীতল করা ঠান্ডা নিয়ে দেখা দেয়। এ সময় এক ফালি রোদ সকলের কাছে বহুল প্রতীক্ষিত হয়ে ওঠে। গ্রাম হোক কিংবা শহর, সব জায়গাতেই শীতের রয়েছে একটি ভিন্ন আমেজ। শীতের সকালে মানুষের মাঝে এক অজানা অলসতা ভর করে। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকাতেই যেন তখন স্বর্গীয় সুখ অনুভূত হয়। কর্মব্যস্ত মানুষ ঘুমের জগতে হারিয়ে যায়। কুয়াশার অন্ধকারে সূর্যদেবতার দেখা পাওয়া ভার। তাই সকালের উপস্থিতি টের পাওয়াও কষ্টকর। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা শীতকেও দূরে সরিয়ে দেয়। তাই আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই হয় সকলকে। নিজেকে তৈরি করে নিতে হয় কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। শীতের সকালে শান্ত প্রকৃতি ভোরের আলো-আঁধারিতে রহস্যময় রূপ ধারণ করে থাকে। তবে ধীরে ধীরে শীতের কুয়াশা কাটতে থাকে। অতঃপর শীতের আকাশে মুচকি হাসি নিয়ে দেখা দেয় রবির কিরণ। এর মধ্যেই শীতের সকালের অপার আনন্দের ছোঁয়া পাওয়া যায়। তাই কবি বলেনÑ
“ঋতুর দল নাচিয়া চলে
ভরিয়া ডালি ফুল ও ফলে,
নৃত্যলোকে চরণতলে মুক্তি পায় ধরা
ছন্দে মেতে যৌবনেতে রাঙিয়া উঠে জ্বরা।”
শীতের সকালে প্রকৃতি ও প্রাণীর অবস্থা : শীতের সকালে প্রকৃতি ও প্রাণীর মধ্যে এক ভিন্ন আমেজ লক্ষ করা যায়। শীতের সময় দিন ছোট এবং রাত বড় হয়। সকাল হয়েও যেন হয় না। মানুষ, জীবজন্তু, পাখ-পাখালি শীতের বেলায় সূর্যের প্রত্যাশায় প্রহর গুনতে থাকে। ঠাÊায় জড়সড় হয়ে থাকতে দেখা যায় সবাইকে। কুয়াশার জালে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে চারদিক। শিশির ঝরতে থাকে অবিরাম। কেবল মানুষই নয়, প্রাণীরাও বাইরে বের হতে চায় না। আড়ষ্ট হয়ে থাকে শীতের প্রকোপে।
গ্রামের প্রকৃতিতে শীতের সকাল : শীতের সকালের প্রকৃত আনন্দ গ্রামীণ জীবনেই খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলার গ্রামগুলোতে শীতের সকাল বেশ মনোরম হয়। গ্রামের মাঠে মাঠে শীতের প্রভাব বেশ চোখে পড়ে। শীতের কুয়াশা ভেদ করে নিজ নিজ গৃহপালিত প্রাণীদের নিয়ে বের হয় গ্রামের কর্মঠ মানুষেরা। সূর্যের দেখা পাওয়া মাত্রই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রোদ পোহাতে শুরু করে। গ্রামের মানুষেরা খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীতকালে উষ্ণতা খুঁজে ফিরে। আগুনের চারপাশে বসে তারা তাপ পোহাতে থাকে। তবে গ্রামীণজীবনে দারিদ্র্যের উপস্থিতি অস্বীকার করা যায় না। বস্ত্রাভাবে দরিদ্র পরিবারের অনেক মানুষের শীতে নাকাল অবস্থা হয়। গ্রামের অনেক প্রবীণ ব্যক্তির প্রাণহানিও ঘটে থাকে শীতের প্রকোপে।
শীতের সকালে গ্রামের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত হলো পিঠা-পুলি খাওয়ার মুহূর্ত। গাছে গাছে খেজুরের রসের হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। সে হাঁড়ি নামালে ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা রস খাওয়ার লোভে ছুটে ছুটে আসে। এ রস দিয়ে নানা রকম পিঠা বানানো হয়। বাড়িতে বাড়িতে মা, চাচি কিংবা দাদিরা সকালবেলাতেই পিঠা তৈরি করতে বসে। অনেকে শীতের ছুটি উপভোগ করতে শহর থেকে ছুটে যায় গ্রামে। শীতের সকালে নানা পিঠা খাওয়ার চিত্রকে তুলে ধরতেই মনে হয় কবি বলেছেন,
“পৌষ মাসে পার্বণে খেতে বসে খুশিতে বিষম পেয়ে
আরও উল্লাস বেড়েছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।”
শহুরে জীবনে শীতের সকাল : শহুরে জীবনে শীতের সকালের রূপ ভিন্ন হয়ে থাকে। গ্রামীণ জীবনের আবেদন এখানে পাওয়া যায় না। ইট-কাঠ-পাথরের শহরে শীতের সকালের আমেজ একদম আলাদা। শহরে দেখা যায় বারান্দায় বসে রোদ পোহানোর দৃশ্য কিংবা গরম চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে খবরের কাগজ পড়ার দৃশ্য। লেপ জড়ানো কর্মব্যস্ত মানুষ নির্দিষ্ট সময়ের পরেও আরও একটু ঘুমিয়ে নিতে চায়। কিন্তু জীবিকার টানে তকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতেই হয়। নিজ নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য গরম কাপড় পরিধান করে প্রস্তুত হতে হয় সকলকে। ঘাসের ওপরে টলমল করতে থাকা শিশির বিন্দু শহরে তেমন একটা দেখা যায় না। খেজুরের রস কিংবা নানা স্বাদের পিঠার সুঘ্রাণ এখানে খুঁজে পাওয়া বিরল। এখানে কেবল কাকের কর্কশ আওয়াজ, যানবাহনের শব্দ এবং মানুষের কোলাহলমিশ্রিত যান্ত্রিক জীবনই দেখা যায়।
উপসংহার : শীতের সকাল অন্য সব ঋতুর চেয়ে একদম আলাদা। শীতের রিক্ততা প্রকৃতির সবুজকে ছিনিয়ে নিলেও দিয়ে যায় ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী বার্তা। কুয়াশার চাদরে ঢাকা গোটা প্রকৃতি শীতকে যে একেবারেই উপভোগ করে না, তা ঠিক নয়। শীতের আবেদন চিরন্তন। হিমঠাÊার কনকনে অনুভূতি প্রতিটি মানুষকে আলোড়িত করে। তাই শীত চলে গেলেও এর রেশ থেকে যায় এবং প্রকৃতি বসন্তের আগমন হেতু অপেক্ষমাণ হয়। তাই তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
‘এসেছে শীত গাহিতে গীত বসন্তেরি জয়,
যুগের পরে যুগান্তরে মরণ করে লয়।