৯ম-১০ম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনাঃ শিষ্টাচার
ভূমিকা : আচরণে ভদ্রতা ও সুরুচিবোধের যৌক্তিক মিলনের নাম শিষ্টাচার। শিষ্টাচার আমাদের মনের সৌন্দর্যের মহৎ উপস্থাপনা। অন্যকথায় সুন্দর আচরণ বা ব্যবহারই হলো শিষ্টাচার। সে আচরণÑকথাবার্তায়, কাজকর্মে, চলনে-বলনে, রীতিনীতিতে সর্বোপরি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। যাকে বলে আদব-কায়দা মেনে চলা বা ভদ্র ব্যবহার ও সৌজন্যবোধ দেখানো; তাই মূলত শিষ্টাচার। বস্তুত সত্যিকারের মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় তার সুন্দর, সংযত ও বিনয়ী ব্যবহার অর্থাৎ, শিষ্টাচার প্রদর্শনে।
মানবজীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব : দেহের সৌন্দর্য অলংকার কিন্তু আত্মার সৌন্দর্য শিষ্টাচার। মানুষ যত দিন অরণ্যচারী ছিল, তত দিন সে শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ প্রকাশের প্রয়োজনবোধ করেনি। যখন থেকে মানুষ সমাজবদ্ধ হলো, তখন থেকে শিষ্টাচার ও ভদ্রতাবোধের প্রয়োজন অনুভূত হয়। শিষ্টাচার শুধু আমাদের ব্যক্তিজীবনের সৌন্দর্যই নয়, আমাদের সমাজজীবনেরও সৌন্দর্যমÊিত করেছে। শিষ্টাচারের গুণেই মানুষের সঙ্গে মানুষের যেকোনো সম্পর্ক রাখা সম্ভবপর হয়। বড় ও বয়স্কদের সম্মান করা, সকলকে আচরণে তুষ্ট করা, ঔদ্ধত্যকে পরিহার করা এবং সবার সঙ্গে প্রীতিময় সম্পর্ক গড়ে তোলাই মানবিক বৈশিষ্ট্য। মার্জিত রুচি ও সুন্দর মনের পরিচয় দিতে হলে কথাবার্তায় ও আচার-আচরণে আমাদের হওয়া উচিত নম্র ও বিনয়ী। আচরণে যে জাতি যত বেশি সভ্য সে জাতি তত বেশি সুশৃঙ্খল ও উন্নত। কেবল পশুপাখির মতো বেড়ে ওঠাই মানুষের লক্ষ্য নয়। আত্মোন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ ও জাতীয় জীবনে কোনো-না-কোনো ভাবে অবদান রাখা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। আর তা করতে হলে শিষ্ট আচরণের অনুশীলন ছাড়া বিকল্প নেই।
ছাত্রজীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব : ছাত্রজীবন হলো মানুষের প্রস্তুতিপর্ব। এরই ওপর নির্ভর করে সফলতা ও ব্যর্থতা, ভবিষ্যৎ জীবনের গতি-প্রকৃতি। এ সময়ই হলো তার শিষ্টাচারও সৌজন্য শিক্ষার যথার্থ কাল। শিষ্টাচার ও সৌজন্যের ছোঁয়াতেই ছাত্র হয় বিনীত, ভদ্র। শিষ্টাচার ও সৌজন্য শিক্ষা তার মনুষ্যত্ব অর্জনেরই সোপান। এরই মধ্যে আছে নিজেকে সুন্দর ও সার্থকতায় পরিপূর্ণ করে তোলার মহাশক্তি। জ্ঞানার্জনে নিষ্ঠা, অভিনিবেশ আর শৃঙ্খলাবোধের পাশাপাশি শিষ্টাচার অনুশীলন খুবই জরুরি। নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষের জন্য ছাত্রজীবনেই ব্যবহারে ভদ্রতা আর শিষ্টতার সম্মিলন ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। জ্ঞানের সাথে শিষ্টাচারের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। একজন ছাত্র যদি শিষ্টাচার বর্জিত হয় তবে সে সকলের কাছেই নিগৃহীত হয়। ফলে একদিকে সে যথার্থ শিক্ষা থেকে যেমন বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে তেমনি ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত হয়। শিষ্টাচার-বিবর্জিত ছাত্র দুর্বিনীত হয়ে থাকে। সে বিভিন্ন ধরনের অন্যায় কাজের সাথে যুক্ত হতে পারে। যা শুধু তার নিজের জন্যই নয় অনেকেরই ক্ষতির কারণ হতে পারে।
শিষ্টাচার অর্জনের উপায় : মহত্ত্ব মানুষকে উদার করে। মানুষের মাঝে এই মহত্ত্বের পরিশীলিত প্রকাশই শিষ্টতা। সাধারণভাবে চালচলন, কথাবার্তায় যে ভদ্রতা, শালীনতা আর সৌজন্যের পরিচয় পাওয়া যায় তা-ই শিষ্টতা। আচরণে যদি মানুষ শিষ্ট না হয় ব্যবহারে উগ্রতা যদি পরিহার না করে তবে কখনো শিষ্টাচারী হওয়া সম্ভব নয়। স্বভাবে কৃত্রিমতা পরিহার করতে না পারলে কখনো পবিত্র মনের অধিকারী হওয়া যায় না। ঔদ্ধত্য আর উচ্ছৃঙ্খলতা শিষ্টাচারের কাছে পরাজিত হয়। অহংকার অন্যকে ছোট ভাবতে শেখায়। শিষ্টতা বিপরীতভাবে মানুষকে সম্মান করতে শেখায়। কদর্যতা আর অশ্লীলতা শিষ্টাচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কাজেই শিষ্টাচারী হতে গেলে ব্যক্তিকে হতে হয় আচরণে মার্জিত, বক্তব্যে সৎ, সরল আর স্পষ্ট। বিনয় মানুষকে ছোট করে না, বরং পরায় সম্মানের কুকুট। এই বিনয় শিষ্টতার অঙ্গভূষণ।
শিষ্টাচারহীন জীবনের কুফল : শিষ্টাচারের গুণেই ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠে সহজ-সরল, স্পষ্ট, সৎ ও মার্জিত। আজ সমাজের নানা ক্ষেত্রেই অশিষ্টাচার ও সৌজন্যহীনতার নিষ্ঠুর চিত্র। দিন দিন মানুষের উচ্ছৃঙ্খলতা বাড়ছে। বাড়ছে তার সীমাহীন ঔদ্ধত্য। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মানুষে মানুষে বিরোধ। শিষ্টাচারের অভাবে সমাজ অন্তঃসারশূন্য, বিবেকহীন হয়ে পড়ছে। চারদিকে আজ বিত্তবানের নির্লজ্জ ঔদ্ধত্য, প্রবলের সীমাহীন অত্যাচার। আজ শিষ্টাচার ও সৌজন্য দুর্বলের ভীরুতারই অসহায় প্রকাশ যেন। দুর্ব্যবহার ও দুর্মূখতাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের সৌন্দর্য হারিয়ে মানুষ আজ নিঃস্ব, হৃদয়হীন।
উপসংহার : শিষ্টাচার অসংখ্য মানবিক গুণের সমষ্টি। প্রত্যেকেরই এ গুণের অধিকারী হওয়া উচিত। কারণ শিষ্টাচারের গুণের মধ্যে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের কল্যাণ নিহিত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যদি এ গুণের অধিকারী হয় তাহলে সমাজ ও জাতিকে সভ্যতার শীর্ষে পৌঁছতে খুব কম সময় লাগবে। মানুষ সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ করবে। তাই বলা যায়, শিষ্টাচার উন্নত জীবনের সিঁড়ি।