৯ম-১০ম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনাঃ মানবকল্যাণে বিজ্ঞান
ভূমিকা : মানুষের জীবনে বিজ্ঞান চেতনার দীপশিখা প্রথম জ্বলে উঠেছিল প্রায় দশ হাজার বছর আগে। সে সময় সভ্য মানুষ শুধু প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনে নয়, নিছক জানার বা বোঝার আগ্রহেই নানা বিষয় সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান আহরণ করতে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় জীবন আমাদের অসংখ্য বিজ্ঞানের আশীর্বাদে ধন্য। আলো ঝলমল একটা আধুনিক সভ্যতা বিজ্ঞানের অবদান। বলা বাহুল্য, বিজ্ঞানের এ সর্বজয়ী স্বরূপটি মানুষই নিরন্তর সাধনায় গড়ে তুলেছে। আদিমকালে জীবনকে আয়েসপূর্ণ, সুখময় ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে মানুষ যে প্রচেষ্টা শুরু করেছিল, আজকের দিনের বিজ্ঞান তারই সুনিয়ন্ত্রিত এবং বিকাশমান প্রয়াস। তাই বিজ্ঞান আজ শত ধারায় ও শত শাখায় বিস্তৃত।
বিজ্ঞান কী? : বিজ্ঞান অর্থ হলো বিশেষ জ্ঞান। ভৌত বিশ্বে যা কিছু পরীক্ষাযোগ্য ও যাচাইযোগ্য তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাÊারের নাম বিজ্ঞান। হারবার্ট স্পেন্সারের মতে, ‘বিজ্ঞান হলো সংঘবদ্ধ জ্ঞানের সমষ্টি।’ বিজ্ঞানী মাদাম কুরী বলেছেন, ‘আমার চোখে বিজ্ঞান হলো অনিন্দ্য সুন্দর।’
বিজ্ঞান চেতনার প্রসার : আদিম যুগে গোষ্ঠীবদ্ধ যাযাবর মানুষের জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল আগুনের আবিষ্কার এবং কৃষিকাজের প্রচলন। উদ্ভাবিত হয়েছিল আদি কৃষি যন্ত্র লাঙল। পরবর্তীকালে মানুষ শস্য সংরক্ষণ, ফসল থেকে আরও নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী বানাতে শিখল, চাকা ঘুরিয়ে মানুষ বানাতে শুরু করল নানা ধরনের মাটির পাত্র। ইরাকের লোকেরা প্রথম চাকাযুক্ত গাড়ি বানিয়ে পরিবহন ব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তন আনল। পানি তোলার উপযোগী বিশেষ ধরনের পাম্প এবং যন্ত্রচালিত ঘড়ি প্রথম আবিষ্কৃত হয় চীনদেশে। গ্রিসের লোকেরা প্রথম পৃথিবী ও মহাকাশের মানচিত্র বানায়। এভাবেই মানুষের অদম্য কৌতূহল ও উদ্ভাবনী শক্তি বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়েছে যুগে যুগে।
আধুনিক বিজ্ঞান : সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর হয়ে বিজ্ঞান বর্তমানে পূর্ণরূপে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। বিজ্ঞানের অসীম শক্তিতে মানুষ আজ প্রকৃতিকে যেন হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। শিল্প জগতে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করল বিজ্ঞান। দ্রুত উৎপাদনের তাগিদে নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের প্রতিযোগিতায় নামে বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানের মহিমায় এখন সব কাজকর্মই হচ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে। বিজ্ঞানের ঐন্দ্রজালিক শক্তিবলে মানুষ উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল নদীর স্রোতকে বশীভূত করেছে। উষর মরু-প্রান্তরকে করেছে জলসিক্ত। ভূগর্ভের সঞ্চিত শস্য সম্ভাবনাকে করেছে উজ্জ্বল। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার বলেই মানুষ এখন সমগ্র পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
মানবজীবনে বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক অবদান : বিজ্ঞান পৃথিবীকে শুধু ছোট করেই দেয়নি, একটি বৃহত্তর গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত করেছে। যোগাযোগ, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ জীবনে হাজারো ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। নিচে এর কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান : প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বিজ্ঞানের নানাবিধ আবিষ্কার ও উপকরণ নিয়ে আমাদেরকে চলতে হয়। সকালে ঘড়ি দেখে ঘুম থেকে উঠে যে পেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করি, তা বিজ্ঞানেরই অবদান। তারপর রান্নার চুলায় ভূগর্ভের গ্যাস, খাবারের টেবিলে পুষ্টি নির্দেশক খাদ্য, অফিস গমনে যান্ত্রিক যান, হিসাব করার জন্য ক্যালকুলেটর, দাপ্তরিক কাজে কম্পিউটার, অবসর বিনোদনে বিভিন্ন উপকরণ ইত্যাদি ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন অচল। মোট কথা, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
পরিবহন ও যোগাযোগে বিজ্ঞান : আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দিয়েছে অভাবনীয় সুবিধা। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে মানুষের সমান পদচারণ। স্থলপথে দ্রুতগামী গাড়ি, বুলেট ট্রেন, জলপথে জাহাজ, আকাশপথে শব্দের চেয়েও দ্রুতগামী সুপারসনিক বিমান মানুষ আবিষ্কার করছে। রকেটে চড়ে পাড়ি দিচ্ছে ভিন গ্রহে। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়ন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থারই ফল।
চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান : চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান এনেছে এক যুগান্তকারী সাফল্য। চিকিৎসাক্ষেত্রে একদিকে প্রতিষেধকের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ হচ্ছে, অন্যদিকে ওষুধ ও শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময় করা হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাইরাস তথা রোগ-জীবাণু শনাক্তকরণ দ্বারা তা নির্মূলে কার্যকর উপায় বের করা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসাসেবার ফলে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের গড় আয়ু। কম্পিউটারকেন্দ্রিক টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো ব্যক্তি উন্নত দেশের ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে। এক্সরে, ই.সি.জি, আলট্রাসনোগ্রাম, ইটিটি, এন্ডোস্কপিসহ সূক্ষ্ম রোগ নির্ণয় পদ্ধতিতে মানবদেহের জটিলতম রোগগুলো নির্ণয় করে সহজেই নিরাময় করা হচ্ছে। ব্রেইন সার্জারি ও ওপেন হার্ট সার্জারির মতো জটিল শল্য চিকিৎসায় সাফল্যের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবিষ্কৃত হয়েছে কৃত্রিম হৃদযন্ত্র ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞান : মানুষের জীবনের অনেক প্রয়োজনীয় উপকরণ উৎপাদনে শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। শিল্প কারখানায় কোনো একসময় সমস্ত কাজই হাতে করা হতো। ফলে মানুষের কাজে সময় ও শ্রম লেগেছে বেশি, কিন্তু উৎপাদন হয়েছে ন্যূনতম। বিজ্ঞানের বলে আজ সেসব কাজ যন্ত্র দ্বারা করানো হচ্ছে। ফলে খরচ ও সময় কম ব্যয় হচ্ছে এবং উৎপাদন হচ্ছে অধিক। বিজ্ঞানের বদৌলতে শিল্পবিপ্লবের ফলে আজ বৃহদায়তনের শিল্পকারখানা স্থাপিত হচ্ছে এবং পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান : কাগজ ও মুদ্রণযন্ত্র শিক্ষাক্ষেত্রে এনে দিয়েছে বিস্ময়কর অগ্রগতি। জ্ঞান ও শিক্ষণীয় কথাবার্তা মুদ্রণ যন্ত্রের কল্যাণে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন মূল্যবান গ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও প্রচারিত হওয়ায় জ্ঞানের আদান-প্রদান সহজতর হয়েছে। দূরশিক্ষণের মাধ্যমে ঘরে বসেই উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ তৈরি হয়েছে। পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল তৈরি ও প্রচার সর্বক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে।
কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান : আধুনিক বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রে অশেষ কল্যাণ সাধন করে আসছে। প্রাচীন ভোঁতা লাঙলের পরিবর্তে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নতমানের কলের লাঙল ও ট্রাক্টর। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে। গবাদি পশু, মৎস্য, হাঁস, মুরগি পালনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ সুফল দিয়েছে। খাদ্যশস্য ও ফলমূল পরিবহন এবং সংরক্ষণে বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল প্রয়োগ হচ্ছে। এককথায় কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান মহাবিপ্লব এনে দিয়েছে।
তথ্যপ্রবাহে বিজ্ঞান : বর্তমান যুগ তথ্যবিপ্লবের যুগ। কম্পিউটার, টেলিফোন, ফ্যাক্স, ই-মেইল, ইন্টারনেট সারা পৃথিবীকে একটি অভিন্ন যোগাযোগ নেটওয়ার্কে আবদ্ধ করেছে। মুহূর্তে মুহূর্তে যেকোনো মানুষ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে অন্য কারো সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। কম্পিউটারকেন্দ্রিক তথ্যপ্রযুক্তি (ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঞবপযহড়ষড়মু-ওঞ) জটিল গণনা থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে এনে দিয়েছে নির্ভুল গতি। স্যাটেলাইট যোগাযোগের কল্যাণে তাৎক্ষণিকভাবে যেকোনো ঘটনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে।
মহাশূন্যের গবেষণায় বিজ্ঞান : মানুষের কৌতূহলী মন আজ বিজ্ঞানের বলে মহাশূন্যের রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যাপৃত হয়েছে। মানুষ চাঁদে, মঙ্গল গ্রহে অভিযান চালিয়েছে। মানুষ বিভিন্ন গ্রহ সম্পর্কে জ্ঞান আরোহণের জন্য মহাশূন্যে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে। মহাকাশে পাঠিয়েছে বিভিন্ন উপগ্রহ যান, রোবট ও অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম।
আবহাওয়ায় বিজ্ঞান : আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে প্রেরণ করছে কৃত্রিম উপগ্রহ। যার ফলে আবহাওয়ার খবরাখবর মুহূর্তের মধ্যেই নির্ভুলভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ এবং অন্যান্য সম্পদের ক্ষতি কম হচ্ছে। তাছাড়া ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে খনিজ ও জলজ সম্পদের এ উৎস সম্পর্কে জানা যাচ্ছে।
বিনোদনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান : মানুষকে মানসিক প্রফুল্লতা দানের জন্য বিজ্ঞান দিয়েছে রকমারি উপকরণ। বিজ্ঞান আজ মানুষের বিনোদন সঙ্গী। বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, ভিসিডি, ক্যামেরা, স্যাটেলাইট চ্যানেল, বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্র বিনোদন জগতে এনেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। আজকের দিনে বিজ্ঞানের কল্যাণে গড়ে উঠছে বিশ্ব সংস্কৃতি। আজকের দিনে চলছে আকাশ সংস্কৃতির জোয়ার। যেকোনো অনুষ্ঠান একই সঙ্গে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারে টেলিভিশনের পর্দায়। মুহূর্তের মধ্যেই জনপ্রিয় গান বা সিনেমা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে ইন্টারনেটের কল্যাণে।
অপকারিতা : বিজ্ঞান কেবল আশীর্বাদই বহন করে আনে না, অভিশাপও বহন করে আনে। এটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, ডিনামাইট, বোমারু বিমান, ট্যাংক, বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কারের ফলে মানবজীবনে বিজ্ঞান আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপেরও কাজ করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা কর্তৃক হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমা ও তার ধ্বংসলীলা এর জলন্ত প্রমাণ।
উপসংহার : মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের দান সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কাছে মানুষ ঋণী। বিজ্ঞানের দানে মানুষ আজ বিশ্বজয়ী। সভ্যতার ক্রমোন্নতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের তুলনা নেই। কিন্তু কতগুলো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষের যুগ-যুগান্তরের কীর্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দুই বিশ্বযুদ্ধে বিজ্ঞানের শক্তির ভয়াবহ ধ্বংসলীলা মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞানকে ধ্বংসের কাজে না লাগিয়ে যদি কল্যাণের কাজে প্রয়োগ করা যায়, তাহলেই বিজ্ঞানের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকবে।