অষ্টম শ্রেণীর বাংলা ২য় পত্র- নির্মিত অংশঃ অনুচ্ছেদ রচনা
অনুচ্ছেদ রচনা
বাক্য মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু সব সময় একটি বাক্যের মাধ্যমে মনের সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। এজন্য প্রয়োজন একাধিক বাক্যের। মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার জন্য পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত বাক্যের সমষ্টিই অনুচ্ছেদ। অনুচ্ছেদে কোনো বিষয়ের একটি দিকের আলোচনা করা হয় এবং একটি মাত্র ভাব প্রকাশ পায়। অনুচ্ছেদ রচনার ক্ষেত্রে কয়েকটি দিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। যেমন-
ক) একটি অনুচ্ছেদের মধ্যে একটি মাত্র ভাব প্রকাশ করতে হবে। অতিরিক্ত কোনো কথা লেখা যাবে ।খ) সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো বাক্যের মাধ্যমে বিষয় ও ভাব প্রকাশ করতে হবে।
গ) অনুচ্ছেদটি খুব বেশি বড় করা যাবে না।
ঘ) একই কথার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ঙ) যে বিষয়ে অনুচ্ছেদটি রচনা করা হবে তার গুরুত্বপূর্ণ দিকটি সহজ-সরল ভাষায় সুন্দরভাবে তুলে ধরতে হবে।
বাংলা নববর্ষ
নববর্ষ সকল দেশের সকল জাতিরই আনন্দ উচ্ছ্বাস ও মঙ্গল কামনার দিন। বাংলাদেশেও পয়লা বৈশাখে সকলের কল্যাণ প্রত্যাশা করে মহা ধুমধামের সাথে নববর্ষ উদ্যাপিত হয়। প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল বাঙালি এই উৎসব পালন করে থাকে। বাঙালির জাতিসত্ত্বা বিনির্মাণে এবং স্বাধীনতা অর্জনে নববর্ষের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সম্রাট আকবরের সময় বাংলা সনের গণনা শুরু হয় বলে ধরণা করা হয়। জমিদার ও নবাবেরা নববর্ষে পূণ্যাহ আয়োজন করতেন। পরবর্তিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নববর্ষ পালন করায় সে আয়োজন দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। নববর্ষে হালখাতা, বৈশাখী মেলা, ঘোড়দৌড় এবং বিভিন্ন লোকমেলার আয়োজন করে সাধারণ মানুষ। সংস্কৃতি সংগঠন ছায়ানট নববর্ষে রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ আয়োজন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এছাড়াও নানা বর্ণিল আয়োজনে দিনটিকে বরণ করা হয়। ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবি এবং মেয়েরা নানা রঙের শাড়ি পড়ে উৎসবে মাতোয়ারা হয়। এই দিনে প্রত্যেক বাঙালি নিজের, বন্ধুর, পরিবার ও দেশের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে।
ছাত্রজীবন
ছাত্রজীবন মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। বিদ্যাশিক্ষার সূচনা থেকে মানুষ জীবনের যে সময়টুকু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো শিক্ষালয়ে অতিবাহিত করে, তা-ই ছাত্রজীবন। ‘ছাত্রনং অধ্যানং তপ’ অর্থাৎ অধ্যয়নই হচ্ছে ছাত্রজীবনের একমাত্র তপস্যা। এই বিষয়টি প্রত্যেক ছাত্রকে স্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে। ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার ও জাতির আশা-ভরসার প্রতীক। দেশ ও জাতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার গুরুদায়িত্ব ভবিষ্যতে ছাত্রদের ওপরই বর্তায়। সে গুরুদায়িত্ব সার্থকতার সাথে বহন করার জন্যে তাদেরকে উপযুক্ত হতে হবে। আধুনিক বিশ্বের নানান খবরাখবর সংগ্রহ এবং তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা একজন ছাত্রের জন্যে অত্যন্ত জরুরি। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকান্ডে ছাত্রদের অংশগ্রহণ থাকা প্রয়োজন। কর্মজীবনে প্রবেশের সোপান হচ্ছে ছাত্রজীবন। ছাত্রজীবনের সফলতা ও ব্যর্থতার ওপর কর্মজীবন অনেকাংশে নির্ভরশীল। এ সময় থেকেই জীবন সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। একজন ছাত্রকে অবশ্যই কুসংসর্গ ত্যাগ করে সততা, সংযম ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে আদর্শ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
সততা
সততা মানবচরিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি গুণ। সর্বদা সত্য কথা বলা, সৎপথে চলা এবং কোনো অন্যায় কাজে লিপ্ত না হওয়ার নামই সততা। একথায় সত্যের অনুসারী মানুষের সৎ থাকার গুণকে সততা বলা হয়। এই গুণ অর্জনের চেষ্টা ও চর্চা একজন মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে মর্যাদা ও গৌরবের আসনে। নিষ্ঠার সঙ্গে নিরলস অনুশীলনের মাধ্যমে এই গুণ অর্জন করা যায়। আর এই গুণ যিনি অর্জন করতে পারেন তিনিই সমাজে আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে থাকেন। সততাকে তাই মানবচরিত্রের অলঙ্কার বলা হয়। সততার সুফল শত ধারায় বিকশিত। জীবনকে সুন্দর সফল ও সার্থক করার জন্য সৎ থাকার অভ্যাস করতে হয়। সৎগুণসম্পন্ন মানুষ কখনোই অন্যায় ও অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকতে পারে না। সৎ লোক মাত্রই চরিত্রবান ও মহৎ হয়ে থাকে। তাই সে সবার বিশ্বাসভাজন ও শ্রদ্ধেয় হয়। সততা মানুষের নৈতিকতাকে সমুন্নত করে। সৎ ব্যক্তি কখনোই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। একটি সমৃদ্ধ ও আদর্শ জীবন গড়ার জন্য সততার বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের উচিত ছাত্রজীবন থেকেই সৎ গুণগুলো অনুশীলন করা। তাহলেই তারা পরিবার ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে।
ছবি আঁকা
মানুষ ভাবতে ভালোবাসে। মানুষের মনে যেসব ভাবনা খেলা করে ছবিতে সেসবের শিল্পময় প্রকাশ ঘটে। কে কখন ছবি আঁকা শুরু করেছিল তা বলা মুশকিল। তবে মানুষের আঁকা সবচেয়ে পুরোনো ছবির কথা জানা যায়। ১১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে আলতামিরা নামক এক গুহায় প্রথম মানুষের আঁকা ছবির সন্ধান মেলে। যেকোনো মানুষই ছবি আঁকে। এমন কোনো মানুষ নেই যে জীবনে কোনো দিন ছবি আঁকেনি। যেকোনো ছবি, হতে পারে তা কোনো পশু, পাখি, মাছ, আম, জাম, কাঁঠাল, পেঁপে, এ কোনো না কোনোটি মানুষ জীবনে একবার হলেও এঁকেছে। আঁকতে আঁকতে অনেকের ছবি আঁকাটাই নেশা হয়ে যায় এবং জীবনে ছবি আঁকা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। ছবি-আঁকা নিয়েই তাদের স্বপ্ন, ছবি-আঁকাই তাদের পেশা হয়ে যায়। তারা নিজেদের প্রতিভার প্রকাশ ঘটায় ছবি-আঁকার মধ্য দিয়ে। পৃথিবীতে অনেকে বিখ্যাত হয়েছেন শুধু ছবি এঁকে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনের এক উজ্জ্বলতম দিন। ১৯৫২ সালের এ দিনে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় রাজপথে প্রাণ দিয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। তাদের সেই আত্মত্যাগের বিনিময়েই নিশ্চিত হয়েছে মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলার অবারিত অধিকার। সেই ঐতিহাসিক ভাষা শহিদদিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেব স্বীকৃতি লাভ করেছে। কানাডা প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’ প্রথম ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়। বিশ্বের ২৭টি দেশ এ প্রস্তাবকে সমর্থন জানায়। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কোর ২১ তম অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বর্তমানে বিশ্বের সকল দেশ এই দিনটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করছে। বাংলাদেশের শহিদদের মহান ত্যাগ এভাবে বিশ্ববাসীর স্বীকৃতিলাভ করেছে। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য এটি একটি বিরল গৌরব। বাংলা ভাষা শহিদ ভাইদের জীবনের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি। তাই এই ভাষাকে আমরা শ্রদ্ধা করব, শুদ্ধভাবে এ ভাষার চর্চা করব। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এটিই হোক সকলের শপথ।
দুর্নীতি
জাতীয় জীবনে উন্নতির অন্যতম অন্তরায় দুর্নীতি। আমাদের জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রকোষ্ঠে দুর্নীতি এমনভাবে প্রবেশ করেছে যে, আজকাল একে এড়িয়ে আমাদের চলাই দায়। অফিস-আদলতে, পেশায়-নেশায়, ঘরে-বাইরে, রাজনীতি কিংবা ধর্মনীতি সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির সর্বগ্রাসী প্রভাব বিদ্যমান। দুর্নীতি যেন সভ্য সমাজে স্বাভাবিক বিষয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরপর বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিদেশি বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে, সাহায্যের হাতও গুটিয়ে নিচ্ছে ধনী দেশগুলো। দুর্নীতির অবাধ বিস্তার সামাজিক ক্ষেত্রে নব্য ধনিকশ্রেণীর সৃষ্টি করছে, জন্ম দিচ্ছে নানামুখী বৈষম্য। সন্ত্রাস নামক যে ভয়ংকর দানব সমাজকে নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে তার পেছনেও রয়েছে দুর্নীতির প্রভাব। দুর্নীতি জন্ম দিয়েছে মূল্যবোধহীনতা যা সমাজকে অবক্ষয়ের অতলে ডুবিয়ে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দুর্নীতি এক দুরারোগ্য ব্যাধি, দুর্বিষহ অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর করাল গ্রাসে জাতীয় উন্নতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। মেধা ও পরিশ্রমের যথাযথ মূল্যায়ণ হচ্ছে না। বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ¶ুণ্ণ হচ্ছে। দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। স্বনির্ভর জাতি গড়ে তোলার জন্য দুর্নীতি নামক এই অভিশাপকে রুখতে হবে এখনই। সকলের সম্মিলিত অঙ্গীকারই পারে এর প্রভাব কমিয়ে আনতে।
সকাল বেলা
সকাল বেলা আমার সবচেয়ে প্রিয় সময়। এ সময়ের শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশ আমাকে খুব আকর্ষণ করে। আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে আমার বাড়ির পাশের নদীর তীরে হাঁটতে যাই। সেখান থেকে সকালের সূর্যোদয় দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। সকালের শীতল বাতাস আমার দেহমন জুড়িয়ে দেয়। নানা রকম পাখির কলকাকলিতে পরিবেশটা মুখরিত হয়ে ওঠে। এ সময় কৃষকেরা গরু নিয়ে হাল চাষ করতে বের হয়। গ্রামের মসজিদে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সমস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আমি বাড়ি ফিরে নাস্তা করে পড়তে বসি। তারপর বন্ধুদের সাথে মিলে স্কুলে যাই। ছুটির দিনে সকাল বেলা আমি বাবাকে নানা কাজে সাহায্য করি। সকাল বেলা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলে আমার সারাটা দিন খুব ভালো কাটে।
আমার মা
পৃথিবীতে মা আমাদের সবচেয়ে আপনজন। অনেক কষ্ট স্বীকার করে তিনি আমাদের জন্ম দেন। অনেক স্নেহ-মমতায় বড় করে তোলেন। আমার কাছে আমার মা সবচেয়ে প্রিয়। মাকে ছাড়া আমি একটি মুহূর্তের কথাও ভাবতে পারি না। মা আমাকে অনেক ভালোবাসেন। সব সময় আমাকে নিয়ে ভাবেন। আমি দুপুরে স্কুল থেকে বা সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরতে দেরি করলে মা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। আমাকে না খাইয়ে কখনো খান না। আমার অসুখ হলে মা আমার যত্ন করেন। রাত জেগে আমার পাশে বসে থাকেন। মা-ই আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আমি মায়ের কাছে কোনো কিছুই গোপন করি না। মা আমাকের কখনোই বকেন না। ভালো পথে চলার জন্য সব সময় পরামর্শ দেন। মা আমার সেরা শিক্ষক। আমার পড়া তৈরিতে তিনি সাহায্য করেন। কঠিন বিষয়গুলো মা সহজেই বুঝিয়ে দেন। আমি মাকে কখনোই কষ্ট দিই না। সবসময় মায়ের কথামতো চলতে চেষ্টা করি। বাড়ির ছোটোখাটো কাজে মাজে সাহায্য করি। আমার মাকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করি ও ভালোবাসি।
আমাদের লোকশিল্প
দেশি জিনিস দিয়ে দেশের মানুষের হাতে তৈরি শিল্প সম্মত দ্রব্যকেই লোকশিল্প বলা হয়। বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপন ও গ্রামীন ঐতিহ্যের সাথে লোকশিল্পের নিবিড় যোগাযোগ বিদ্যমান। নানা ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পে আমাদের দেশ সমৃদ্ধ। ঢাকাই মসলিন নিয়ে আজ অবধি আমরা গর্ববোধ করি। লুপ্তপ্রায় নকশি কাঁথা আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যের স্মারক। আমাদের দেশের লোকশিল্প বিভিন্ন রূপে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে প্রাধান্য পেয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা, টাঙ্গাইল, সাহজাদপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এলাকার তাঁতশিল্প উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের জামদানি, খুলনার মাদুর, সিলেটের শীতল পাটি আমাদের সবার পরিচিত। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পীদের তৈরি পোড়ামাটির কলস, হাঁড়ি, পাতিল, সানকি, ফুলদানি, পুতুল ও আমাদের লোকশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গ্রামের ঘরে ঘরে শিকা, হাতপাখা, বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র, কাপড়ের পুতুলও আমাদের দেশের মানুষের রুচির পরিচায়ক। লোকশিল্প যেমন আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে তেমনি বিদেশী মুদ্রা উপার্জনেও অবদান রাখে। এর ভেতর দিয়ে দেশের অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব। তাই লোকশিল্পের সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
পরিবেশ দূষণ
মানুষসহ অন্যান্য জীবজন্তু পরিবেশ ও প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির দানেই মানুষ নানা অঙ্গিকে নিজের জীবনকে সাজিয়ে তুলেছে। অথচ অবিবেচক মানুষদের কারণেই পরিবেশ আজ ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে পরিবেশ দূষণের পেছনে মানুষের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যার বিষ্ফোরণের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ- বায়ু, পানি, মাটির ওপর প্রন্ড চাপ পড়ছে। বনজ সম্পদ ধ্বংসের রীতিমতো উৎসব চলছে বিশ্বজুড়ে। ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাতাসে ধুলোবালি, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, কীটনাশক ইত্যাদির উপস্থিতি বাড়ছে আশংকাজনকভাবে। কলকারখানার বর্জ্য, কীটনাশক ইত্যাদি পানিকে করে তুলেছে বিষাক্ত। হাজারো রকমের উৎকট শব্দের কারণে শব্দ দূষণ ঘটছে। নষ্ট হচ্ছে মনের শান্তি। ক্ষতিকর রাসায়নিক ও যত্রতত্র আবর্জনা ফেলায় দূষিত হচ্ছে মাটি। এভাবে দূষিত হতে থাকলে এক সময় পরিবেশের ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে এই বিশ্ব জীবের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। তাই পরিবেশ দূষণ যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সবারই ভূমিকা রাখা উচিত। সকলের সচেতনতাই আমাদের পরিবেশকে সুস্থ ও সুন্দর করে তুলতে পারে।
বইমেলা
বই মানবসভ্যতার অন্যতম প্রাণসত্তা। বই মানুষকে পূর্ণতা দেয়, জীবনকে করে সমৃদ্ধ। বইমেলা প্রত্যেক জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। বইমেলা উপলক্ষে বই বিক্রেতা ও প্রকাশকরা নানা সাজে বইয়ের স্টল বা দোকান সাজিয়ে বাসেন। এখানে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের সমাহার ঘটে। বইমেলা উপলক্ষে প্রচুর নতুন বই মেলায় আসে। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখকদের বইও পাওয়া যায় এখানে। প্রতিদিন বইয়ের আকর্ষণে বই প্রেমিক মানুষেরা মেলা প্রাঙ্গণে ছুটে আসে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি লেখক, ভাষাবিদ ও বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা বইমেলায় আসেন। লেখক ও পাঠকদের মিলনমেলায় রূপ নেয় এই মেলা। বইমেলার ফলে পাঠকরা এক জায়গা থেকে তাদের পছন্দের বই কিনতে পারে। এছাড়া বই কেনার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহও তৈরি হয়। বইমেলা আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিবোধ জাগ্রত করে। সবাইকে বই পড়ার প্রতি অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে একটি মননশীল জাতি গঠনের ক্ষেত্রে বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একসাগর রক্তের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাঙালি জাতির কাছে স্বর্ণময় এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তা জানানোর জন্য সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ১৯৯৬ সালের ২২শে মার্চ ঢাকাস্থ সেগুনবাগিচার একটি দোতলা ভবনে প্রতিষ্ঠা করা হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত তথ্য, প্রমাণ, বস্তুগত নিদর্শন, রেকর্ডপত্র ও স্মারকচিহ্নসমূহ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের সুব্যবস্থা করা হয়েছে এখানে। দোতলা বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মধ্যে রয়েছে ছয়টি গ্যালারি : নিচ তলায় তিনটি ও দোতলায় তিনটি। প্রথম গ্যালারির নিদর্শনগুলো দুটি পর্বে বিন্যস্ত। প্রথম পর্বে প্রদর্শিত হয়েছে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। দ্বিতীয় পর্বে প্রদর্শিত হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংগ্রামের চিত্র। দ্বিতীয় গ্যালারিতে তুলে ধরা হয়েছে পাকিস্তান আমলের ইতিহাস। দোতলার তিনটি গ্যালারি সাজানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য, প্রমাণ ও চিত্র দিয়ে। প্রতিটি গ্যালারিতে আছেন একজন চৌকশ গাইড। তিনি দর্শনার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে তাদের কৌতূহল নিবৃত করেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর চত্বরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানারকম বই, পোস্টার, ক্যাসেট, সিডি, স্মারকসামগ্রী বিক্রির জন্য একটি পুস্তকবিপণি, একটি খাবারের দোকান ও একটি উন্মুক্ত মঞ্চ এবং সামনের অংশে আছে ১০০ আসন বিশিষ্ট একটি চমৎকার অডিটোরিয়াম। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে দেশের মানুষকে সচেতন করতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অডিটোরিয়ামে ভিডিও প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমন্ত্রিত দর্শকদের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। উন্মুক্ত মঞ্চে আয়োজন করা হয়ে থাকে নানা অনুষ্ঠানের। জাদুঘর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি-স্মারক-দলিলপত্রের একমাত্র সংগ্রহশালা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে জানতে পারে, ভুলে না যায়, সে লক্ষ্যই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্টিত ও পরিচালিত হয়ে আসছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বর্তমান সময়ে অত্যন্ত আলোচিত একটি বিষয়। উন্নত দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এটি একটি সময়োচিত পদক্ষেপ। ডিজিটাল বাংলাদেশ কী, এ বিষয়কে বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে একটি দেশ কীভাবে ডিজিটাল দেশে পরিণত হতে পারে। একটি দেশকে তখনই ডিজিটাল দেশ বলা যাবে যখন তা ই-স্টেটে পরিণত হবে। অর্থাৎ ওই দেশের যাবতীয় কাজ যেমন- সরকারব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি প্রভৃতি কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। তাই একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ডিজিটাল বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। ২০২১ সালে পালিত হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। সেই লক্ষ্যে এ সময়ের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। সাধারণভাবে বলতে গেলে একটি ডিজিটাল সমাজ নিশ্চিত করবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সমস্ত কর্মকান্ডে অনলাইন প্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত হবে। কার্যকর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি সুশাসিত সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করাই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। এক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী তথ্যপ্রযুক্তি কাঠামো গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ঘাটতির সমাধান, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক কাঠামোর উন্নয়ন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রশিক্ষণ, ইংরেজি শিক্ষার ব্যবহারসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্বায়ন সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তি দ্রুত প্রসারের ফলে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে ডিজিটাল উন্নয়নের চলমান প্রক্রিয়ায়। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামক প্রকল্পের সাথে সাধারণ মানুষের যোগসূত্র তৈরি করতে হবে। তবেই উন্নত, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের এই স্বপ্ন পূরণ হবে।
শীতের সকাল
শীতের সকাল অন্যসব ঋতু থেকে আলাদা। কুয়াশার চাদরে মোড়া শীতের সকাল হাড় শীতল করা ঠান্ডা নিয়ে দেখা দেয়। এ সময় এক ফালি রোদ সকলের কাছে বহুল প্রতীক্ষিত হয়ে ওঠে। শীতের সকালে মানুষের মাঝে এক অজানা অলসতা ভর করে। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকাতেই যেন তখন স্বর্গীয় সুখ অনুভূত হয়। কুয়াশার অন্ধকারে সূর্যদেবতার দেখা পাওয়া ভার। তাই সকালের উপস্থিতি টের পাওয়াও কষ্টকর। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা শীতকেও দূরে সরিয়ে দেয়। তাই আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই হয় সকলকে। নিজেকে তৈরি করে নিতে হয় কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। শীতের সকালে প্রকৃতি ও প্রাণীর মধ্যে এক ভিন্ন আমেজ লক্ষ করা যায়। মানুষ, জীবজন্তু, পাখ-পাখালি শীতের বেলায় সূর্যের প্রত্যাশায় প্রহর গুনতে থাকে। শীতের সকালের প্রকৃত আনন্দ গ্রামীণ জীবনেই খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলার গ্রামগুলোতে শীতের সকাল বেশ মনোরম হয়। গ্রামের মাঠে মাঠে শীতের প্রভাব বেশ চোখে পড়ে। শীতের কুয়াশা ভেদ করে নিজ নিজ গৃহপালিত প্রাণীদের নিয়ে বের হয় গ্রামের কর্মঠ মানুষেরা। সূর্যের দেখা পাওয়া মাত্রই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রোদ পোহাতে শুরু করে। গ্রামের মানুষেরা খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীতকালে উষ্ণতা খুঁজে ফিরে। শীতের সকালে গ্রামের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত হলো পিঠা-পুলি খাওয়ার মুহূর্ত। গাছে গাছে খেজুরের রসের হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। এ রস দিয়ে নানা রকম পিঠা বানানো হয়। গ্রামীণ জীবনের আবেদন ইট-কাঠ-পাথরের শহুরে জীবনে পাওয়া যায় না। শহরে দেখা যায় বারান্দায় বসে রোদ পোহানোর দৃশ্য কিংবা গরম চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে খবরের কাগজ পড়ার দৃশ্য। লেপ জড়ানো কর্মব্যস্ত মানুষ নির্দিষ্ট সময়ের পরেও আরও একটু ঘুমিয়ে নিতে চায়। কিন্তু জীবিকার টানে তকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতেই হয়। সর্বোপরি সকলের কাছেই শীতের সকাল হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময়।