৯ম-১০ম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনাঃ দেশ ভ্রমণ
ভূমিকা : মানুষ জন্মসূত্রেই স্বাধীনচেতা। মানুষ সীমাবদ্ধ গন্ডির বাইরে গিয়ে অজানাকে জানতে চায়। এ পৃথিবীতে প্রকৃতির অফুরন্ত সম্ভার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, বন-বনানী সৌন্দর্যের অপরূপ ডালি সাজিয়ে রেখেছে এ পৃথিবীতে। মানুষ অসীম আগ্রহ আর অনন্ত উৎকণ্ঠা নিয়ে এ নৈসর্গিক দৃশ্যকে অবলোকন করার জন্য দেশ ভ্রমণে ছুটে চলছে। এ যেন এক দুরন্ত নেশা। এর মাঝে যে রোমাঞ্চ রয়েছে তার স্বাদই আলাদা। জীবনের আনন্দকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগের জন্য, জীবন ও জগৎকে জানার জন্য, দেশে দেশে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশ ভ্রমণ অপরিহার্য।
প্রাচীনকালে দেশ ভ্রমণ : ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রাচীনকাল থেকেই দেশভ্রমণের অস্তিত্ব লক্ষণীয়। প্রাচীনকালে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। সমুদ্রপথে তখন পাল তোলা জাহাজ চলত আর স্থলপথে ঘোড়ায় চড়ে অথবা পায়ে হেঁটে দেশ ভ্রমণ করতে হতো। প্রাচীনকালে আকাশপথে চলাচলের কথা মানুষ ভাবতেও পারত না। এ সকল দিক বিবেচনা করলে অনুধাবন করা যায় যে, প্রাচীনকালে দেশ ভ্রমণ অনেক কষ্টসাধ্য ছিল। একমাত্র দুঃসাহসী ও কষ্টসহিষ্ণু সাহসীরাই দেশ ভ্রমণ করে জ্ঞানার্জন করেছেন।
আধুনিককালে দেশ ভ্রমণ : দেশ ভ্রমণের জন্য আধুনিক যুগ মানুষকে অত্যন্ত সুবিধা এনে দিয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে জল, স্থল ও আকাশপথে মানুষ স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করতে পারে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মানুষ পাড়ি দিতে পারে হাজার হাজার মাইল পথ। তাই দেশ ভ্রমণ এখন আনন্দদায়ক ও আরামদায়ক। ফলে আধুনিককালে দেশ ভ্রমণের গÊি হয়েছে প্রসারিত। প্রতিদিনই মানুষ ব্যবসা বাণিজ্য ও জ্ঞানার্জনের জন্য ছুটে যাচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। শুধু সৌন্দর্য উপভোগের জন্য হাজার হাজার মানুষ সুদূর ইউরোপ থেকে ছুটে আসছে ভারতীয় উপমহাদেশে। অবলোকন করছে তাজমহল, উপভোগ করছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের অপার সৌন্দর্য। আবার এশিয়া থেকেও মানুষ ইউরোপ অমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা দেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে।
দেশভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা : পৃথিবীতে অসংখ্য জাতি ও সম্প্রদায়ের বাস। এ জাতিগুলো পৃথিবীর সর্বত্র বিক্ষিপ্তভাবে বাস করছে। এমন বহু জাতি আছে, যাদের সঙ্গে দৈহিক বর্ণ, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-পরিচ্ছদ, রীতি-নীতি প্রভৃতিতে আমাদের কোনো মিল নেই।
দেশ-ভ্রমণ ব্যতিরেকে আমরা তাদের সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞানলাভ করতে পারি না। শুধু গ্রন্থ পাঠ করেই আমরা যথাযথ ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও সামাজিক জ্ঞান অর্জন করতে পারি না। এ সকল বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞানার্জনের জন্য দেশ ভ্রমণ আবশ্যক। কবি, শিল্পী ও চিত্রকরগণেরও কর্তব্য দেশ ভ্রমণ করে নানা দেশের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করা। এতে তাঁরা নিজে প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করতে পারবেন। দেশ পর্যটনের ফলে ভূগোলতত্ত্ব ও ভূবিদ্যা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারা যায়। প্রাচীনকাল হতে বহু পর্যটক, ভূতত্ত্ববিদ নানা দেশ ভ্রমণ করে ঐ সকল দেশ সম্বন্ধে নানা কথা লিপিবদ্ধ করে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। হিউয়েন সাঙ, ফা-হিয়েন, ইবনে বতুতা প্রভৃতি বিখ্যাত পর্যটক সেকালের ভারত পরিভ্রমণ করে যে সকল মূল্যবান তথ্য লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন, সেগুলো ইতিহাসের প্রধান উপকরণ। ভূতত্ত্ববিদ্গণ বহু দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে বিভিন্ন জনপদ, দুস্তর মরুভূমি দুরারোহ গিরিশৃঙ্গ, গভীর অরণ্য পর্যটন করেছেন বলে আমরা জগতের বহু তথ্য জানতে পেরেছি।
দেশ ভ্রমণের উপায় : অতীতের তুলনায় বর্তমানে দেশ ভ্রমণ সহজ, তবে ব্যয়সাপেক্ষ। প্রচুর পরিমাণ অর্থ থাকলে পৃথিবীর ঐতিহাসিক স্থানগুলো সহজেই দেখে আসা যায়। কিন্তু এ অর্থ জোগাড় করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজসাধ্য নয়। দেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বে আর একটি জটিলতা পরিলক্ষিত হয়। তাহলো বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা। আগেকার দিনে দেশ ভ্রমণের জন্য কোনো পাসপোর্ট ভিসার দরকার হতো না। বিশ্ব বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাঙ, ফাহিয়েন প্রমুখ ব্যক্তিগণ দেশের পর দেশ মুক্ত বিহঙ্গের মতো চষে বেড়িয়েছেন। যেসব দেশে তাঁরা গিয়েছেন সেসব দেশের মানুষের কাছে তাঁরা প্রচুর সমাদর পেয়েছেন। আজকের বিশ্বে বেড়ানোর সুবিধা হয়তো আছে, কিন্তু সেকালের মানুষের মতো প্রাণের অমন অফুরন্ত ভাÊার আজ নেই। আজকাল বাইসাইকেলে করেও অনেকে বিশ্বভ্রমণ করছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, ইবনে বতুতা কিংবা হিউয়েন সায়ের সুযোগ্য উত্তরসূরিরা বসে নেই।
দেশ ভ্রমণের উপকারিতা : দেশ ভ্রমণ করলে আমাদের অনেক উপকার হয়। দেশ ভ্রমণ করলে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, কার্যদক্ষতা বাড়ে এবং মনের সংকীর্ণতা দূর হয়। যারা কূপমÊূক, তারা আপনার গৃহ সীমার বাইরে গমন করে না; ফলে তাদের জ্ঞান প্রসারিত হয় না, হৃদয় সংকীর্ণ ও অনুদার থাকে। পক্ষান্তরে, নানা দেশ ভ্রমণ করলে বহুদর্শিতা লাভ করা যায়। বহুদর্শিতা থাকলে সাহস বৃদ্ধি পায় এবং অভিজ্ঞতার সাহায্যে সে কার্যে সঠিক পন্থা অবলম্বন করতে পারি।
দেশ পর্যটনের ফলে আমরা ব্যবসায়-বাণিজ্যের কৌশল ও তত্ত্ব সম্যকরূপে অবগত হতে পারি। কোন্ দেশে কোন্ দ্রব্য অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়, কোন্ দেশে কোন্ দ্রব্যের চাহিদা বেশি দেশ ভ্রমণের ফলে তা বিশেষভাবে জানা যায়। দেশ পর্যটনের ফলে এ সকল বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান জন্মে।
দেশ ভ্রমণ শিক্ষার অঙ্গ : শিক্ষার সত্যিকারের বিষয় জীবন ও প্রকৃতি। প্রকৃতির অফুরন্ত পাঠশালা থেকে পাঠ গ্রহণ করতে হলে মানুষকে অবশ্যই ঘর থেকে বেরোতে হয়। বিদ্যালয়ের সংকীর্ণ আঙিনা কিংবা নিজস্ব গÊির বাইরেও রয়েছে বিরাট পৃথিবী। বৈচিত্র্যময় এ অনন্ত পৃথিবী সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলে মানুষের জ্ঞান পূর্ণ হয় না। এ সুন্দর ভুবনের নানা স্থানে রয়েছে যে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, অসংখ্য জনপদে ছড়িয়ে আছে যে বিচিত্র পরিবেশ, বহুমাত্রিক জীবন তা নিজের চোখে না দেখলে অভিজ্ঞতার ঝুলি কখনোই পূর্ণ হয় না। মানুষের জ্ঞানইন্দ্রিয় প্রধানত দুটি, চোখ এবং কান। চোখ দিয়ে আমরা দেখি আর কান দিয়ে শুনি। দেখা ও শোনা ছাড়া শিক্ষা বা জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়া কখনো সম্পূর্ণ হয় না। একমাত্র ভ্রমণই আমাদের জন্য এ দুর্লভ সুযোগ এনে দিতে পারে। তাই ভ্রমণ শিক্ষার প্রয়োজনীয় অঙ্গ। এজন্য ইউরোপ এবং আমেরিকায় ভ্রমণকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
উপসংহার : প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে আধুনিককালে রেলগাড়ি, উড়োজাহাজ প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাচীনকালের ন্যায় দেশ পর্যটনে অধিক অর্থ বা সময় ব্যয় হয় না, কষ্টও করতে হয় অনেক কম। আজকাল আমরা অনায়াসে পৃথিবীর যেকোনো অংশ ভ্রমণ করে এর প্রাকৃতিক রূপ-বৈচিত্র্য দর্শন করে অভিজ্ঞতা ও আনন্দ লাভ করতে পারি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দেশভ্রমণের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। তা হলে ছাত্র-ছাত্রীগণ নানা দেশ ভ্রমণ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারবে।