৯ম-১০ম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনাঃ সংবাদপত্র

ভূমিকা : বর্তমানে সংবাদপত্র মানুষের অপরিহার্য সঙ্গী। প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, বিরহ-ব্যথার বার্তা বহন করে সংবাদপত্র। প্রতিদিন সারা বিশ্বের বার্তাসহ সংবাদপত্র আমাদের দ্বারে দ্বারে উপনীত হয় বলে, মানবজীবনের সঙ্গে সংবাদপত্রের এত বেশি সম্পৃক্ততা। সংবাদপত্র হলো সারা বিশ্বের একটা দর্পণস্বরূপ। বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে এক পলকে তা ভেসে ওঠে আমাদের চোখের সামনে সংবাদপত্রের মাধ্যমে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বহু দল ও মতের ধারক-বাহক হিসেবে সংবাদপত্র সরকার ও জনগণের মধ্যে রচনা করে সেতুবন্ধ।

সংবাদপত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ : সংবাদপত্র সর্বপ্রথম কোথায় উৎপত্তি হয়েছিল তার সঠিক তথ্য অজানা। তবে ধারণা করা হয়, চীন দেশে সর্বপ্রথম সংবাদপত্রের সূচনা ঘটে। পাশ্চাত্য দেশগুলোর মধ্যে সম্ভবত ইতালি প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করে। তবে চীনেই প্রথম কাগজ ও মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল শাসনামলে রাজ্য পরিচালনার সুবিধার্থে হস্তলিখিত সংবাদপত্রের প্রচলন ঘটেছিল। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে সংবাদপত্র জগতে অভাবনীয় পরিবর্তন আসে।

বাংলাদেশে সংবাদপত্রের ইতিহাস : বাংলাদেশে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে সর্বপ্রথম সর্বসাধারণের জন্য সংবাদপত্রের প্রচলন করা হয়। জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাংলা ভাষায় প্রথম সাময়িক পত্র ‘দিগদর্শন’ ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়। বাঙালি পরিচালিত প্রথম পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক গেজেট’ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষায় প্রথম দৈনিক ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ ১৮৩১ সালে সাপ্তাহিক এবং ১৮৩৯ সালে দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।

সংবাদপত্রের প্রকাশিত বিষয়সমূহ : সংবাদপত্রে বিশ্বের খবরাখবরের পাশাপাশি রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক পরিস্থিতি প্রভৃতি নিয়ে নিয়মিত ফিচার, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। চিঠিপত্র, ব্যবসা-বাণিজ্যের হালচাল, শেয়ারবাজার, নানা বিজ্ঞাপনও সংবাদপত্রে সন্নিবেশিত হয়। এছাড়া আজকাল বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন, ফটো ফিচার সংবাদপত্রে নতুন মাত্রা এনেছে। নিয়মিত খবরাখবর পরিবেশনের পাশাপাশি বর্তমানে সংবাদপত্রগুলোতে থাকে নানা সাপ্তাহিক আয়োজন।

আধুনিক জীবনে সংবাদপত্রের প্রভাব : আধুনিক জীবনে সংবাদপত্রের গভীর ও ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সংবাদপত্র একদিকে যেমন জাতীয় তেমনি আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশন করছে। ফলে এর মাধ্যমে জনগণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা তথ্যের সাথে পরিচিত হয়। আবার এর সম্পাদকীয় মন্তব্য তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এভাবে জনগণ নানাবিধ সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হয়। ফলে জনমত গঠনের সুযোগ পাওয়া যায়। সুষ্ঠুভাবে গণতন্ত্র পরিচালনায় সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে জনসাধারণ রাষ্ট্রের নীতি ও কর্মপন্থার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে, আবার সংগঠনমূলক আলোচনা করার সুযোগও পায়।

বাংলাদেশের সংবাদপত্র : বর্তমানে বাংলাদেশে ১৮০০-এর বেশি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল, দৈনিক ইনকিলাব, সংবাদ, জনকণ্ঠ, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, দিনকাল, মানবজমিন, যায়যায়দিন, নয়াদিগন্ত, বাংলাদেশ অবজারভার, মর্নিং নিউজ ইত্যাদি পত্রিকা এবং বেগম, বিচিত্রা, আনন্দভুবন, আনন্দ আলো, সচিত্র বাংলাদেশ, রোববার, সপ্তাহের বাংলাদেশ, অনন্যা, অন্যদিন, আনন্দধারা ইত্যাদি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা বিশেষ উল্লেযোগ্য।

জাতীয় জীবনে সংবাদপত্রের গুরুত্ব : একটি জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সংবাদপত্র মানুষকে বিশ্ব-পরিস্থিতি ও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে আধুনিক যোগ্য নাগরিকে পরিণত করে। দেশ-দেশান্তরের রাজনীতি-অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়কসংক্রান্ত আলোচনা তার চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে সৃষ্টিশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করে। অশিক্ষিত, অসচেতন মানুষের দেশে গণতন্ত্র কখনও সফল হতে পারে না। সংবাদপত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভালোমন্দ দিক বিশ্লেষিত ও আলোচিত হয়, যা দেশের নাগরিককে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বা পছন্দের রাজনৈতিক দল বেছে নিতে সহায়তা করে। সংবাদপত্র দেশে নানা নীতিনির্ধারণী বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করে; সে সম্পর্কে বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের মতামত প্রকাশ করে। সরকার ও বিরোধী দলের ভালোমন্দ কাজ নিয়ে সমালোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করে। আমরা দেখেছি আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংবাদপত্র কি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংবাদপত্রসমূহ জনমত গড়ে তুলে এ দেশবাসীকে নানা আন্দোলনে সক্রিয় করে তুলেছে।

সংবাদপত্রের ক্ষতিকর দিক : সংবাদপত্রের মধ্যে মহত্তর সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ জনসেবার মহৎ উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে সংবাদপত্রের পরিচালকবৃন্দ ও সাংবাদিকগণ দলগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধির মানসে সংবাদপত্রকে কখনো কখনো হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। জাতীয় জীবনে এর প্রভাব তখন মারাত্মক হয়ে ওঠে। আবার দেশের মধ্যে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও প্রাদেশিকতা, কোন্দল ও বিদ্বেষের ভাব, নানা রূপ কুৎসা ও মিথ্যা রটনার জন্য অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদপত্রই দায়ী। ¶ুদ্র তুচ্ছ স্বার্থ সাধনের বশবর্তী হয়ে সাংবাদিকগণ যখন বিবেক বিসর্জন দেয়। তখন সংবাদপত্র জনসাধারণের অকল্যাণের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়? স্বার্থবুদ্ধির ফলে সাংবাদিকরা মিথ্যাচার করলে এর পরিণাম কী ভয়াবহ হতে পারে তা অনুমান করা যায় না।

উপসংহার : বর্তমানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে আধুনিক যুগে স্যাটেলাইট, টিভি, ইন্টারনেট প্রভৃতি সংবাদপত্রের প্রতি যোগী হয়ে উঠেছে। আজ যে ঘটনা ঘটছে তা মুহূর্তেই মানুষ জানতে পারছে বিবিসি কিংবা অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমে, যা খবরের কাগজে পাওয়া যায় পরের দিন। তাই বলে ইলেকট্রনিক মিডিয়া সংবাদপত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ তা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। বরং এগুলো প্রায়ই সংবাদপত্রের সহায়করূপে কাজ করে। তাই আমরা দেখতে পাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শীর্ষে অবস্থানকারী দেশগুলোতে সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা বরং তুলনামূলকভাবে বেশি। সংবাদপত্র সচেতন মানুষ গড়ার কাজে একনিষ্ঠ থাকে, সুবিধাবাদী মানুষের হাতিয়ারে পরিণত না হয় তাহলে এর প্রয়োজন কখনও শেষ হবে না।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *