৯ম-১০ম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনাঃ বাংলাদেশের পোশাক শিল্প

ভূমিকা : বাংলাদেশের পোশাক শিল্প অন্যান্য শিল্পের তুলনায় বেশ এগিয়ে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগ অংশই আসে এই শিল্প থেকে। এই শিল্প বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এককালে মসলিন ও জামদানির জন্য পৃথিবীখ্যাত বাংলাদেশ আবার বস্ত্রক্ষেত্রে নতুন ধরনের গৌরব অর্জনের পথে পা বাড়িয়েছে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ এখন সুপরিচিতি লাভ করেছে পোশাক শিল্পের কল্যাণে।

বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের সূচনা : বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে মূলত ১৯৭৬ সাল থেকে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। আশির দশকের গোড়ার দিকে গার্মেন্ট শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। মূলত বেসরকারি উদ্যোগেই এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ দেশে ১৯৮৩ সালে মাত্র ৫০টির মতো কারখানা ছিল। বর্তমানে তা তিন হাজারেরও অধিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ সময়ের মধ্যে কর্মসংস্থানও ১০ হাজার থেকে শুরু করে প্রায় ৩০ লাখে উপনীত হয়েছে, যা উৎপাদন খাতে নিয়োজিত মোট শ্রমিকের ১৫%-এরও অধিক। পোশাক শিল্প খাত বর্তমানে দেশের অর্থনীতির বৃহৎ খাত, বৈদেশিক বাণিজ্যের সর্ববৃহৎ খাত এবং নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী বৃহৎ খাত।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বাজার : বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ক্রেতা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় ক্রেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার পরেই ইউরোপ ও কানাডা। বিশ্বের ১২২টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে। যুক্তরাজ্য ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পোশাকের বেশ চাহিদা রয়েছে। ফলে এর বাজার যেমন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি এর উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশা করা যায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোশাক শিল্প বিরাট অবদান রাখবে এবং দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পোশাক শিল্প সুদূরপ্রসারী অবদান রেখে চলেছে। এ খাতের অবদানের প্রধান দিকগুলো হচ্ছে :
১. জাতীয় আয়ের প্রায় ৬৪ অংশ আসে এই খাত থেকে। তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রাণপ্রবাহ সচল রাখতে সাহায্য করছে।
২. প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে এই খাতে। এরা পেয়েছে স্বাবলম্বী জীবন ও অর্থনৈতিক মর্যাদা।
৩. পোশাক শিল্প বিকশিত হওয়ায় দেশে রপ্তানিজাত আইটেমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। বর্তমানে রপ্তানি আয়ের ৬৩% আসছে এই শিল্প থেকে।
৪. পোশাক শিল্প দেশে দ্রুত শিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন স্পিনিং, উইভিং, নিটিং ডাইং, ফিনিশিং এবং প্রিন্টিং শিল্প প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়া গার্মেন্টস শিল্প রপ্তানির জন্যে প্যাকেজিং, গামটেপ, জিপার, বোতাম ও বগলস শিল্পের প্রসার ঘটেছে।
৫. তৈরি পোশাক শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ২৫৪৯ কোটি ডলার।
৬. পোশাক শিল্পের সামগ্রী আমদানি ও রপ্তানির ফলে বন্দর থেকে ফ্যাক্টরি পর্যন্ত পরিবহন শিল্পের অগ্রগতি হয়েছে এবং এসবের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে।
৭. গার্মেন্ট শিল্পে বিনিয়োগ করে ব্যাংক লাভবান হচ্ছে। বিমা কোম্পানির প্রিমিয়ামের পরিমাণ বাড়ছে।

পোশাক শিল্পের সমস্যা : বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে এখনো নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সরকার পোশাক শিল্পের অনুকূলে প্রায়ই মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে যাচ্ছে। তথাপিও সুদের হার এবং অন্যান্য আর্থিক নীতি এ খাতের অনুকূল নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বন্দর সুবিধাও পর্যাপ্ত নয়। অসুবিধাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অস্পষ্ট খরচ। ফাইল মুভমেন্ট, এলসি খোলা, মাল খালাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে নানা ধরনের অস্পষ্ট ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা এ শিল্পকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কাঁচামাল ঢাকার কারখানায় পৌঁছাতে যেখানে সাত দিন সময় লাগার কথা সেখানে বর্তমানে প্রায় একুশ দিন লেগে যায়।

সমস্যা সমাধানে সরকারের করণীয় : ইতিমধ্যে সরকার পোশাক শিল্পের রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। যেমনÑ এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম, এক্সপোর্ট পারফরম্যান্স লাইসেন্স, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত এলাকা স্থাপন, রপ্তানিকারকদের বিদেশ সফরের সুবিধা, সরকারি পুরস্কার ইত্যাদি। তারপরও আরও কিছু করণীয় সরকারের রয়ে গেছে। এগুলো হচ্ছে :
১. মূল্য সংযোজন কর হার কমিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে শক্তিশালী প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে টিকে থাকতে সহযোগিতা করা।
২. কারখানা বিমার ক্ষেত্রে ফ্লাড সাইক্লোন শর্ত শিথিল করা।
৩. দ্রুত রপ্তানির জন্য কার্গো বিমান চার্টার করার অনুমতি প্রদান।
৪. লোডশেডিং বন্ধ করা এবং নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা।
৫. রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে ইপিজেডের মতো সুযোগ-সবিধা প্রদান।
৬. পোশাক শিল্প প্রসারের জন্যে উদারভাবে সুযোগ-সুবিধা প্রদান।
৭. কোটানীতি-সংক্রান্ত দুর্নীতির অবসান।
৮. আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আরো নতুন নতুন পোশাক তৈরির দিকে মনোযোগ প্রদান।
৯. বস্ত্রশিল্পের চাহিদা অনুযায়ী দেশে পর্যাপ্ত কাঁচামাল উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ।

পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা : পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বলে মনে করা হয়। তবে বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এজন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহকে আইএসও সনদ গ্রহণ করতে হবে; যেহেতু ক্রেতারা এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। সর্বোপরি দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের বস্ত্র ও পোশাকের মানোন্নয়ন, মূল্য হ্রাস করে চ্যালেঞ্জকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

উপসংহার : আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য দেশের সাথে প্রবল প্রতিযোগিতা করেই আমাদেরকে টিকে থাকতে হবে। কিন্তু অবকাঠামোগত সুযোগ-সবিধার অভাবসহ বিরাজিত অন্যান্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ এখনই না নিলে ভবিষ্যতে মুক্ত বাজারে আমাদের এ সম্ভাবনাময় খাতটি যে মার খাবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। বিশেষত আমাদের কাঁচামাল দিয়েই যদি আমরা পোশাক তৈরি করতে পারি তা হবে দেশের জন্য সোনায় সোহাগা। পোশাক শিল্পের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোকে সমাধান করে বিশ্বের দরবারে এই শিল্পকে অনন্য মর্যাদায় আসীন করা যায়।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *