৯ম-১০ম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনাঃ আমার শৈশব স্মৃতি

ভূমিকা : জীবন গতিশীল। আর এই গতিই বেঁচে থাকা। গতি হারানোর অর্থই মৃত্যু। জীবনের এই ছুটে চলার মাঝে অনেক পদচিহ্ন পেছনে পড়ে থাকে। জীবনছবির ফ্রেমে সেই দিনগুলো বাঁধিয়ে রাখলে হয় তো একটি মহাকাব্য হবে। সেই কাব্যে যেমন থাকবে সুখের মোহনীয় মুহূর্তগুলোর রোমাঞ্চকর স্মৃতি, আবার এর বিপরীত অনেক কিছু থাকবে, যা শুধু যন্ত্রণাই বাড়াবে। ইচ্ছে করবে কলমের একটানে মুছে ফেলতে। নয় তো ইচ্ছে করবে এমন করে ভাবতে- ‘এটা আমার জীবনের পর্ব নয়।’ কিন্তু যা একবার ফেলে এসেছি তা ফিরে না এলেও মনের পাতা থেকে, জীবন খাতা থেকে মুছে ফেলা যাবে না। এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতার খাতার হিসাব মিলিয়েই নির্ধারিত হয় মানুষের পরবর্তী জীবনের এমনকি পরপারের জীবনের পথচলা। তাই, ফেলে আসা দিনগুলি যতই তুচ্ছ ভাবি তুচ্ছ নয় ঐদিনের সিঁড়ি বেয়েই আসে জয়-পরাজয়।

জীবনটা খুব ছোট : বাংলাসাহিত্যের অমর কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন,‘ আমাদের জীবনটা খুব ছোট। একটা কচ্ছপ বাঁচে তিনশ বছর। মানুষ একশ বছরও বাঁচে না।’ তাঁর মতো বড়মাপের মানুষরা যখন এমন কথা বলেছেন, তখন আমি কী আর বলব, আমার ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে? আমার জীবনের ফেলে আসা স্মৃতি ভরা দিনগুলো এখনো পরিপুষ্টই হয়নি। এখনও স্কুলের বারান্দা দিয়ে কেবল হাঁটছি। কৈশোর পেরিয়ে এখনো যৌবনের দ্বারে পা পড়েনি।
‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না-
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না-
সেই- যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।।
এই গান গাওয়ার সময় এখনো আমার আসেনি। তারপরও জীবন খাতার পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে কিছু স্মৃতিময় স্মরণীয় ক্ষণ।
কিছু উজ্জ্বল স্মৃতি : আমার ফেলে আসা দিনের ফ্রেমে আছে একটা সোনালি শৈশব। গ্রামের সবুজ-শ্যামল আঁচলের ছায়া। মায়ের স্নেহভরা মিষ্টি মুখ। বাবার কর্মক্লান্ত অথচ হাসোজ্জ্বল প্রিয়মুখ। বাঁশবাগানের মাথায় ওঠা চাঁদ। বাড়ির পিছন দিয়ে বয়ে চলা ছোট নদী। গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেলিম স্যারের আদরভরা শাসন। বন্ধুদের সাথে দুপুরের রৌদ্রে ঘুড়ি ওড়ানোর ধূসর ম্মৃতি। নদী, বিল-ঝিলের পানিতে মাতামাতি, জেলেদের মাছ ধরার ছবি। আজও মনের কোণে উঁকি দেয় ঝুপ করে মাছরাঙার পাখির মাছধরা কিংবা কাঠঠোকরার খট-খট শব্দে কাঁঠাল গাছে গর্ত করার ছবিগুলো।

শীতকালের কিছু মধুর স্মৃতি কোনো দিন ভোলা যাবে না। ভাইবোন সবাই মিলে চুলার কাছে বসে মায়ের পিঠা বানানো দেখতে দেখতে পিঠা। তারপর শিশির ভেজা ভোরে চাচা, চাচি, মামা, মামি, ফুফু ও চাচাতো, মামাতো ভাই-বোনেরা আসতেন। পাড়াপ্রতিবেশীরা আসতেন। সবাই মিলে একসাথে বসে শীতের পিঠা খাওয়ার পর ঝালমুখ করা হতো হাঁসের গোশত দিয়ে গরম গরম ভাত। খাওয়ার পর্ব শেষে ভাই-বোনরা সবাই রঙিন ঘুড়ি হাতে বেরিয়ে যেতাম পাশের মাঠে। সর্ষে ক্ষেতের সবুজ পাতার পাতায় হলদে ফুল আহ! কী মনকাড়া ছবি। তারপর সারাদিন হইচই। স্কুল হোস্টেলের এই বন্দিদশায় খুব বেশি বেশি মনে পড়ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা শেষের সেই সোনালি দিনগুলো।

বৈশাখ মাসে আকাশে মেঘ করলে মা ব্যস্ত হয়ে যেতেন আমাদেরকে ঘরে নিতে, আর আমরা মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে আম কুড়াতে চলে যেতাম আমাদের বাগানে। বাড়ি ফিরে আমগুলো দিতাম মায়ের হাতে। তারপর মা হাসিমুখে হাজির হতেন কাঁচা আমের সাথে কাসুন্দী মিশিয়ে নিয়ে। সেই স্বাদ ভোলার নয়। এখনো ভাবলে জিভে পানি আসে।

আরো মনে পড়ে আষাঢ়, শ্রাবণ মাসে টিনের চালে ঝুম-ঝুম বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে অলস দুপুরে ভাইবোনে মিলে তিনগুটি, লুডু কিংবা দাবা খেলার মধুর স্মৃতি। এখন পড়ালেখার এত চাপ খেলার কথা ভাবতেই পারি না।

বড় বুবুর বিয়ে। সবাই ব্যস্ত বিয়ের আয়োজনে। আমাদের পক্ষ থেকে কলাগাছে রঙিন কাগজ লাগিয়ে গেট করা হয়েছে। তার সাথে রঙিন কাপড়ে সুন্দর কারুকাজ। পালকি চড়ে বর এলো। দুই পক্ষের মধ্যে চলল ধাঁধার পাল্লা। না জিতলে বরকে বাড়িতে আসতে দেওয়া হবে না। অনেক সময় ধরে চলল। কিন্তু না, কোনো পক্ষই কম নয়। হারার নাম নেই কারো। দাদু ভাই এগিয়ে গিয়ে বরকে মানে পাগড়ি পরা দুলাভাইকে নিয়ে এলেন। হাতে রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন দুলাভাই। এখন ভাবতে গেলে খুব হাসি পায়। আর সেদিন বুবু যখন পালকিতে উঠে তার শ্বশুরবাড়ি চলে যায় খুব কেঁেদছিলাম।

প্রতিদিন তিনবার রান্নার পর প্লেটে খাবার নিয়ে মায়ের স্নেহভরা ডাক, এই স্কুল হোস্টেলে নেই। ঘড়ি দেখে নিজেকেই যেতে হয় ডাইনিং টেবিলে। এখন আমি মায়ের স্নেহের ছায়া ছেড়ে অনেক দূরে শহরের স্কুলের হোস্টেলে থাকি। হাই স্কুলে পড়ি। অনেক বড় হয়ে গেছি কারণ আমাকে অনেক বড় হতে হবে। মা-বাবার স্বপ্ন আমি পড়ালেখা শিখে প্রকৃত মানুষ হব। তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করব। তাই স্নেহ, মায়া আর স্মৃতির ফাঁদে বাঁধা পড়লে চলবে না।

সামনে চলার শক্তি : ফেলে আসা দিনগুলো ফিরে আসবে না। তারপরও মানুষ ফেলে আসা দিনে ফিরে যেতে চায়। আমার ফেলে আসা দিনগুলোও আমাকে দার“ণভাবে ভাবায়, আনন্দ আর বেদনার মাঝে জড়িয়ে রাখে। এখনকার দিনগুলো একসময় অতীত হবে। তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে চলার শক্তি খুঁজে ফিরি সবসময়।

উপসংহার : আমার অতীত দিনগুলোকে ফেলে আসা দিন বললেও ফেলে আর আসতে পারলাম কই! আমার মনের ফ্রেমে বন্দি হয়ে আছে সেই দিনগুলো। আমার জীবনের সাথে মিশে আছে। আমি যখন যেখানে যাচ্ছি তারাও আমার সাথে সাথে চলছে। কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। হয়তো কোনো দিন পারবও না। কারণ সেই দিনগুলো আমার জীবনেই অংশ। তার সাথে মিলিয়েই গড়ে উঠছে আমার ভবিষ্যৎ। অতীতকে ভুলে ভবিষ্যৎ গড়ার চিন্তা করা অসম্ভব। তাই আমি আমার ফেলা আসা দিনগুলোর স্মৃতিগুলো খুব যত্নের সাথে মনের মাঝে সংরক্ষণ করছি। সেই স্মৃতির শক্তিতে আগামী দিনের মজবুত ভিত গড়ার প্রত্যাশাকে লালন করে পথ চলছি।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *